আমাদের প্রথম কাজ ছিল গবেষণার জন্য সাবজেক্ট (যাদের নিয়ে কেসস্টাডি তৈরি করা হবে) খুঁজে বের করা। এটা করতে গিয়ে সবচেয়ে বেশি সমস্যা মোকাবিলা করতে হয়েছে, শিক্ষিত তরুণ সমাজ(আমাদের সাবজেক্ট এর সবাই বিশ্ববিদ্যালয়/মেডিকেল কলেজ এর শিক্ষার্থী ছিলেন) সহজ বাংলায়ও যৌনতা বিষয়ক অনেক শব্দ জানেন না, এমনকী পুরো বিষয় ব্যাখ্যা করার পরও তারা বলেছেন যে তারা বিষয়টি সম্পর্কে জানেন না। এখন আমাদের প্রশ্ন ছিল তারা কি আসলেই জানেন না! নাকি বলতে চাচ্ছেন না! যদি বলতে না চান, সেক্ষেত্রে কোন ওজর-আপত্তি নেই, তারা তাদের ব্যক্তিগত অনুভূতি না-ই বলতে চাইতে পারেন। কিন্তু তারা যদি আসলেই না জানেন তবে এর দায় আমি কাকে দিবো! কারণ এই না জানার দায় ওই শিক্ষার্থীর নয় অবশ্যই। এই দায় আমাদের মানসিকতার। আমরা সারাদিন বসে বসে আড্ডা দিচ্ছি অমুক নায়ক হট, অমুক নায়িকা তো বেহেশতের পরী! এই হট নায়ক আর বেহেশতের পরীর শরীরের প্রতি আমাদের দুর্বার আকর্ষণ অথচ আমরা কাজের কাজটাই জানিনা। আমরা জানিনা যৌনতা (সেক্সুয়ালিটি) মানে শুধুই শারীরিক আকর্ষণ আর শারীরিক সম্পর্ক নয়। যৌনতা শুরু হয় জন্মের পর থেকেই, আমরা কিভাবে বেড়ে উঠছি, কোন লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণবোধ করছি, কিভাবে নিজেদের প্রকাশ করছি, বয়ঃসন্ধিতে আমাদের শরীরে কি কি পরিবর্তন আসছে, এই পরিবর্তন আমরা কিভাবে নিচ্ছি, একটা বয়সের পর আমরা কিভাবে না জেনে যৌন সম্পর্কে জড়িয়ে যাচ্ছি, বা জেনে যৌন সম্পর্কে জড়ালেও সেটা কিভাবে নিরাপদ রাখা যায়, যৌনাঙ্গের সুস্থতা কিভাবে রক্ষা করতে হয়, যৌনরোগ ও অবাঞ্চিত গর্ভধারণ থেকে কিভাবে সহজে বেঁচে থাকা যায়, মানসিক সুস্থতার সাথে যৌনতা কতটুকু জড়িত, আরো ছোট ছোট অনেক বিষয়।
এসবের কিছুই আমরা জানিনা। আমরা জানি শুধু এটাকে বোকার মত নিষিদ্ধ ভেবে লুকিয়ে লুকিয়ে আলোচনা করতে আর মুচকি হাসতে। এই মুচকি হাসি আর এড়িয়ে যাওয়ার মানসিকতার কারণে না জানি কত রোগ আমাদের মনে আর শরীরে বাসা বাঁধছে! না জানি আমাদের মধ্যে কতজন বিকৃত রুচির মানুষ জন্ম নিচ্ছে! না জানি কত বিয়ের সম্পর্ক ভেঙ্গে যাচ্ছে! না জানি কত শিশু ধর্ষণের শিকার হচ্ছে! না জানি কত শিক্ষিত নারী-পুরুষ তার স্বামী-স্ত্রী দ্বারা ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন! না জানি কত শিশু ভ্রুণ অবস্থায় মারা যাচ্ছে! না জানি কত কিশোর-কিশোরী শারীরিক পরিবর্তন কে মেনে নিতে না পেরে নিজেদের ভিনগ্রহের প্রাণী ভেবেছে, নিজেকে অবাঞ্চিত মনে করেছে।
কিন্তু এগুলো আমরা জানতে পারছি না কেন? কারণ আমরা ছোটবেলা থেকে জানছি, "সেক্স!" ওটা একটা নেগেটিভ শব্দ! ওটা শুধু স্বামী-স্ত্রীর বেডরুমের গল্প, নোংরা সম্পর্কের গল্প, পর্ণোগ্রাফির গল্প। বাচ্চাদের এটা বলতে নেই। বাচ্চাদের এটা জানতে নেই। এমনকি অবিবাহিতরাও এটা জানতে পারবে না, তাহলে সমাজে অনৈতিক সম্পর্ক বেড়ে যাবে। আরে ভাই! কে বলেছে আপনাকে বেডরুম স্টোরি জানাতে! আপনি আপনার বাচ্চাকে বলে দিননা যে, কাউকে তোমার স্পর্শকাতর অঙ্গে হাত দিতে দিবে না, কাউকে অতি ভালোবাসার অভিনয় করতে দিবে না! তাহলেই হয়ত আপনার ছেলে বা মেয়ে শিশুটি বেঁচে যাবে কোন ভয়ানক যৌন নিপীড়ণ থেকে অথবা সে একটু হলেও আপনাকে বলতে পারবে কিছু, প্রোটেস্ট করতে পারবে। এটাই তো যৌন শিক্ষা!
যখন আপনার মেয়েটির প্রথম মেন্সট্রুয়েশন হল তার হাতে শুধু সেনোরার প্যাকেট না ধরিয়ে দিয়ে আর মাথার উপর কড়া বিধি-নিষেধ এর ঝান্ডা না গেড়ে, তাকে বোঝান যে তুমি একা নও, সবার জীবনে এমন ঘটে, এটা লজ্জার ঘটনা নয়, গর্বের ঘটনা। তবে তোমার এসময় সাবধানতা অবলম্বণ করতে হবে, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে। তাহলেই দেখবেন আপনার মেয়েটি বেঁচে যাবে অনেক ইনফেকশন থেকে, অনেক রোগ থেকে। এটাই তো যৌন শিক্ষা! বাচ্চাকে ভালো রাখবে, খারাপ করবে না।
আর ছেলেদের শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনের কথা না-ই বা বললাম! মেয়েদের তাও তো একটা সাপোর্ট সিস্টেম থাকে, কারণ তাদের শারীরিক পরিবর্তন কে বাবা-মা স্বাভাবিক মনে করেন, কিন্তু ছেলেদের তাও থাকে না। কোন এক কিশোর অনেক এক আগে এক অনুষ্ঠাণে বলেছিল যে তার বাবা যখন তার প্রথম স্বপ্নদোষের কথা জানতে পারেন তখন তিনি ছেলেটির কম্পিউটার সিজ করে দেন, তার যুক্তি ছিল, তুমি নিশ্চই পর্ণ দেখছো! নাহলে এটা হবে কেনো! এমন ছেলের অভাব নেই বাংলাদেশে। তাহলে বলুন কোথায় যাবে এই কিশোর! এই হচ্ছে আমাদের যৌনশিক্ষার আসল চিত্র।
সবার যে এমন হয়েছে তা বলবো না। এমন অনেক সাবজেক্ট আমরা পেয়েছি যারা অনেক কিছু জানেন এবং বেশ ভালোভাবে জানেন। আমাদের গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে সব ছেলে-মেয়েরা পরিবার থেকে শিক্ষা পেয়েছে বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আনুষ্ঠানিক যৌনশিক্ষা পেয়েছে অথবা নিজেরা বই পড়ে জেনেছে, তাদের জীবনে অন্যদের তুলনায় সমস্যা কম হয়েছে এবং তারা মানসিকভাবেও অনেক উদারপন্থী ও সুস্থ। আর যারা পরিবার থেকে তেমন কোন শিক্ষা পায়নি, তারাই আকৃষ্ট হয়েছে "ভালগার" পর্ণোগ্রাফিতে এবং মানসিকভাবেও কোন না কোন সময় ভেঙ্গে পরেছে, নিজেকে অবাঞ্চিত মনে করেছে।
আরেকটা বিষয় ছিল অধিকাংশ মেয়েরা তাদের নিজের সতীত্ব এর উপর জোর দিয়েছে, স্বামীর সতীত্বের চেয়ে। আর ছেলেরাও স্ত্রীর সতীত্বের উপর জোর দিয়েছে, নিজের সতীত্বের চেয়ে। ঘুরে ফিরে সেই একই হিসাব। সতী থাকতে হবে নারীকেই, পুরুষকে নয়। এখনও আমরা এটা ভাবতে পারছি না যে আমি যখন সঙ্গীকে "পিউর" চাচ্ছি তাহলে আমার নিজের পিউরিটিরও একটা ব্যাপার থাকা উচিত,অথবা নিজের "পিউরিটি" নিয়ে যখন মাথা ঘামাচ্ছি না তখন আরেকজনেরটা নিয়েও মাথা ঘামানোর কিছু নেই যদি সে সৎ ও বিশ্বস্ত থাকে।
এরকম আরো অনেক বিষয় ছিল। যার পরে আমরা শুধু একটি সিদ্ধান্তেই পৌঁছাতে পেরেছি যে বাচ্চাদের মধ্যে একটা নির্দিষ্ট বয়সের পর থেকে ধীরে ধীরে "প্রসেসড" উপায়ে যৌনশিক্ষা দিতে শুরু করলে তারা অনেকটাই নিজেকে সামলাতে পারবে, সমাজে যৌন অপরাধও কমে যাবে, স্বাস্থ্য ইনডেক্স এও আমরা এগিয়ে যাবো। সবচেয়ে বড় কথা তরুণ সমাজ এতটা কনফিউজড থাকবে না,তারা সঠিক পথেই এগুবে।
" ভালো কোন কিছু জানা কে না নয়, অপরাধকে না বলি জানার মাধ্যমে"
→[সংগৃহীত ও পরিমার্জিত]
No comments:
Post a Comment