নববধূর উপঢৌকনঃ প্রথম পর্ব

{“তুহফাতুল আরুস” বই অবলম্বনে }

বিবাহ একটি ইবাদত

আল্লাহর নিয়ামত হিসেবে বিবাহ
আনন্দ ছাড়া মানব জীবনটা একঘেয়েমি। বিবাহের একটি প্রধান উদ্দেশ্য হল মানব প্রজাতির সংরক্ষণ ও ধারাবাহিকতা বজায় রাখা। নারী ও পুরুষের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের একমাত্র বৈধ পন্থা হচ্ছে বিবাহ। বিয়ে একটি পরিবারের ভিত্তি। বিবাহের মাধ্যমেই নারী-পুরুষ তাদের চূড়ান্ত প্রশান্তি লাভ করতে পারে।

“এবং আরেক নিদশর্ন এই যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের সঙ্গী সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তিতে থাকতে পার এবং তিনি তোমাদের পারস্পরিক সম্প্রীতি ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয় এতে চিন্তাশীল লোকদের জন্য নিদর্শনাবলী রয়েছে।” [সুরা রূম : ২১]

এই আয়াতের একথা স্পষ্ট বুঝে আসে যে, স্বামী-স্ত্রীর মাঝে বৈবাহিক সম্পর্কের মূল ভিত্তি হলো শান্তি, স্বস্তি ও ভালোবাসা। আর এ বিষয়গুলো সম্পূর্ণই মানসিক উপাদান, বৈষয়িক উপাদান নয়। এই বিষয়গুলোর অনুপস্থিতিতে বৈবাহিক জীবন অর্থহীন হয়ে পড়ে। বিবাহটা একটা দৈহিক চাহিদা পূরণের উপকরণ হয়ে যায়। তাই ইসলাম স্বামী-স্ত্রীর পারস্পারিক আবেগ ভালোবাসা কেন্দ্রিক চাহিদাগুলোর প্রতি যত্মবান হতে নির্দেশ দিয়েছে।

“তিনিই সে সত্তা যিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এক ব্যক্তি থেকে এবং তার থেকে বানিয়েছেন তার সঙ্গিনীকে, যাতে সে তার নিকট প্রশান্তি লাভ করে।” [সূরা আরাফ : ১৮৯]

স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক নিছক একটি ভোগবাদী সম্পর্ক নয় বরং এর দ্বারা আত্মিক সম্পর্ক তৈরি হয়,এর মাধ্যমেই তৈরি হয় পারস্পারিক প্রেম, ভালোবাসা, উদারতা, সমবেদনা, আস্থা ও একে অপরের জন্য আত্মোৎসর্গের মনোভাব। বিবাহের মাধ্যমেই শারীরিক, মানসিক এবং আধ্যাত্মিক সাহচার্য অর্জিত হয়।

বিবাহের শ্রেষ্ঠত্ব
“মেয়েদের মধ্যে থেকে যাদের ভাল লাগে তাদের বিয়ে করে নাও দুই, তিন, কিংবা চারটি পর্যন্ত। আর যদি এরূপ আশঙ্কা কর যে, তাদের মধ্যে ন্যায় সঙ্গত আচরণ বজায় রাখতে পারবে না, তবে, একটিই।” [সুরা নিসাঃ ০৩]

“তারা তোমাদের জন্য পোশাকস্বরূপ এবং তোমরাও তাদের জন্য পোশাকস্বরূপ।” [সুরা বাকারাঃ ১৮৭]

এখানে নারী ও পুরুষকে একে অপরের পোশাক বলা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, পারস্পারিক সহায়তা, পারস্পারিক স্বস্তি  এবং পারস্পারিক সুরক্ষার ক্ষেত্রে তারা শরীরের পোশাকের মতই।পোশাক বলার দ্বারা তাদের অভিন্নতা ও ঐক্যর দিকটি তুলে ধরা হয়েছে। পোশাক যেমন মানব শরীরের বেশি নিকটবর্তী, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কটিও তেমনি অত্যন্ত কাছের। পোশাক এমন জিনিস যা শরীরকে ঢেকে রাখে এবং সুরক্ষা দেয় তেমনি স্বামী-স্ত্রীও পরস্পরের অভিভাবক ও সুরক্ষাকারী।পোশাক যেমন পরিধানকারীর সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে তাকে পূর্ণতা প্রদান করে, তেমনি স্বামী-স্ত্রী একে অপরকে পূর্ণতা দান করে। এই বৈবাহিক সম্পর্কই তাদের চারিত্রিক বিশুদ্ধতা সংরক্ষিত হয়।

“যখন একজন বিয়ে করে তখন দ্বীনের অর্ধেক অংশ পূরণ করল, বাকী অর্ধেক অংশে সে যেন আল্লাহকে ভয় করে”। (বায়হাকী)

বিয়ের মাধ্যমেই একজন মুসলিম/মুসলিমাহ তার জীবনসঙ্গীকে খুঁজে পেতে পারে। স্বামী-স্ত্রী একে অপরের জন্য স্বয়ংসম্পূর্ণতা স্বরূপ। তারা একে অপরের ভাল কাজের সাহায্যের মাধ্যমে পরিপূর্ণতা দানেও সাহায্য করে। যারা তাদের আদর্শ জীবনসঙ্গীকে খুঁজে পেতে চায় তারা দুই রাকাত নামায পড়ে ইস্তিখারাহর দোয়া পাঠ করে আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করতে পারে।

আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর ইবনে আস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, “পার্থিব জগতটাই হল ক্ষণিক উপভোগের বস্তু। আর পার্থিব জগতের সর্বোত্তম সম্পদ(উপভোগের বস্তু) সাধ্বী নারী।” (সহীহ মুসলিম)

আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, অপর একটি হাদিসে আছে, “যে ব্যক্তি চরিত্র রক্ষার উদ্দেশ্যে বিবাহ করে, আল্লাহ তা’আলা তার সাহায্য করাকে নিজের প্রতি অবধারিত করে নিয়েছেন।” (তিরমিযি, নাসাঈ)

চারিত্রিক শুদ্ধতা
“যারা বিবাহে সামর্থ নয়, তারা যেন সংযম অবলম্বন করে যে পর্যন্ত না আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে অভাবমুক্ত করে দেন। তোমাদের অধিকারভুক্তদের মধ্যে যারা মুক্তির জন্য লিখিত চুক্তি করতে চায়, তাদের সাথে তোমরা লিখিত চুক্তি কর যদি জান যে, তাদের মধ্যে কল্যাণ আছে। আল্লাহ তোমাদেরকে যে, অর্থ-কড়ি দিয়েছেন, তা থেকে তাদেরকে দান কর। তোমাদের দাসীরা নিজেদের পবিত্রতা রক্ষা করতে চাইলে তোমরা পার্থিব জীবনের সম্পদের লালসায় তাদেরকে ব্যভিচারে বাধ্য কারো না। যদি কেহ তাদের উপর জোর-জবরদস্তি করে, তবে তাদের উপর জোর-জবরদস্তির পর আল্লাহ তাদের প্রতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” [সূরা নূরঃ ৩৩]

আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, “হে যুব সম্প্রদায়, তোমাদের মধ্যে যারা বিবাহের সামর্থ্য রাখে সে যেন বিবাহ করে। কেননা তা চক্ষুকে অবনত করে এবং লজ্জাস্থানকে হেফাজত করে। আর যে এর সামর্থ্য রাখে না, তার কর্তব্য রোজা রাখা। কেননা তা জৈবিক উত্তেজনার প্রশমন ঘটায়।” (বুখারি, মুসলিম)

যুবক-যুবতীদের বিয়ে যৌন সম্ভোগের ক্ষেত্রে খুবই স্বাদপূর্ণ হয়। তাদের মুখের গন্ধ মিষ্টি হয়, দাম্পত্য জীবন সুখকর হয়, পারস্পারিক কথাবার্তা আনন্দদায়ক হয়, দেখতে খুবই সৌন্দর্যমন্ডিত হয়, স্পর্শ আরামদায়ক হয়, তাদের চারিত্রিক গুণাবলি সৃষ্টি হয়। যুবক বয়সেই যেহুতু ব্যভিচারের সম্ভাবনা বেশি থাকে। তাই এ বয়সেই বিয়ের প্রতি উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। এসময় বিয়ে করলে, তার অন্তর যত্রতত্র যৌনাকাঙ্ক্ষা মেটানোর জন্য ঘুরে বেড়াবে না। আর সামর্থ্য না থাকলে, রোযা রাখার মাধ্যমে যৌন কামনাকে কমিয়ে রাখা যায়।

ইবাদতের ভুল ধারণা
“তোমার পূর্বে আমি অনেক রাসূল প্রেরণ করেছিলাম এবং তাদেরকে স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি দিয়েছিলাম।” [রা‘দ ১৩/৩৮]

“রাসূল (ছাঃ)-এর স্ত্রীদের নিকট আগত তিন ব্যক্তির এক ব্যক্তি আল্লাহর ইবাদত করার স্বার্থে বিবাহ না করার সিদ্ধান্ত করে। তার  প্রতিবাদে রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, “আমি নারীদেরকে বিবাহ করি (সুতরাং বিবাহ করা আমার সুন্নাত)। অতএব যে আমার সুন্নাত থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবে সে আমার দলভুক্ত নয়।” (বুখারি, মুসলিম)

উপরোক্ত হাদিসে বিয়ের ব্যপারে উৎসাহ দান করা হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর সুন্নাত মোতাবেক আমাদের ইবাদত করতে হবে। তাই বিবাহ যেহুতু রসুলের সুন্নাত সেহুতু বিবাহ না করে চিরকুমার ও নিঃসঙ্গ জীবন যাপনের অনুমতি ইসলামে নেই।ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেছেন, “বিবাহিত অবস্থায় একদিন কাটানো, এক বছর ইবাদতের চেয়ে উত্তম।” ইবনে মাসউদ (রাঃ) যখন প্লেগে আক্রান্ত হয়ছিলেন,তখন বলেছিলেন, “আমাকে বিয়ে করিয়ে দাও। আমি অবিবাহিত অবস্থায় আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করাকে পছন্দ করি না।” ইমাম ইবনে হাম্বল বলেছেন, “আমি একটি রাতও স্ত্রী ছাড়া কাটানোকে অপছন্দ করি।”

(চলবে)