নববধূর উপঢৌকনঃ দ্বিতীয় পর্ব

বিবাহের পূর্বে

১. দ্বীনদারিত্ব ও বিবাহ
“হে মানব, আমি তোমাদেরকে এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা পরস্পরে পরিচিতি হও। নিশ্চয় আল্লাহর কাছে সে-ই সর্বাধিক সম্ভ্রান্ত যে সর্বাধিক পরহেযগার। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সবকিছুর খবর রাখেন।” [সুরা হুজুরাত: ১৩]

“তোমাদের মধ্যে যারা বিবাহহীন, তাদের বিবাহ সম্পাদন করে দাও এবং তোমাদের দাস ও দাসীদের মধ্যে যারা সৎকর্মপরায়ন, তাদেরও। তারা যদি নিঃস্ব হয়, তবে আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে সচ্ছল করে দেবেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ।” [সুরা নুর: ৩২]

এখানে একা বলতে যারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয় নি বা তালাকপ্রাপ্তা অথবা বিধবাদের বুঝান হয়েছে।

আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, “তোমরা যে ব্যক্তির নৈতিক চরিত্র ও দ্বীনদারিত্বে সন্তুষ্ট আছ, তোমাদের নিকট সে ব্যক্তির বিয়ের প্রস্তাব করলে, তবে তার সাথে বিয়ে দিয়ে দাও। যদি না কর তাহলে পৃথিবীতে ফিতনা-ফ্যাসাদ ও বিপর্যয় সৃষ্টি হবে।” (তিরমিযী,মিশকাত)

জাবির (রাঃ) থেকে বর্ণিত, “মহিলাদের বিয়ে করা হয় চারটি জিনিস দেখে। তার সৌন্দর্য, সম্পদ, বংশ ও দ্বীনদারিত্বে দেখে। অবশ্যই তুমি দ্বীনদার পাত্রীকে প্রাধান্য দিবে,কল্যাণে তোমার হাত পরিপূর্ন হবে।” (তিরমিযী, বুখারি, মুসলিম)

এই হাদিসে বিবাহের ক্ষেত্রে ধার্মিকতাকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। কারণ, একজন ধার্মিক স্ত্রী তার স্বামীর জীবনের প্রতিটি ভাল কাজের ক্ষেত্রে সঙ্গী হয়। সে সন্তানদেরকে সুষ্ঠুভাবে প্রতিপালন করে, তার স্বামীর অনুগত হয়, তার শপথ পূর্ণ করে, যখন স্বামী দেখে তখন আনন্দ অনুভব করে এবং স্বামী যখন বাইরে থাকে তখন তার সম্পদ ও সম্মানের রক্ষণাবেক্ষণ করে।

২. ব্যভিচারীরা একে অপরকে বিবাহ করে
“ব্যভিচারী পুরুষ কেবল ব্যভিচারিণী নারী অথবা মুশরিকা নারীকেই বিয়ে করে এবং ব্যভিচারিণীকে কেবল ব্যভিচারী অথবা মুশরিক পুরুষই বিয়ে করে এবং এদেরকে মুমিনদের জন্যে হারাম করা হয়েছে।” [সুরা নুর: ৩]

ইবনে হাম্বল (রহঃ) বলেছেন, একজন মুসলিমের একজন ব্যভিচারীনিকে তওবা না করা পর্যন্ত বিবাহ বৈধ হবে না। শুধুমাত্র তওবার পর তার বিবাহ বৈধ হবে। একইভাবে তওবা না করা পর্যন্ত একজন ব্যভিচারকে একজন মুসলিম মহিলার বিবাহ নিষিদ্ধ।

৩. বাহ্যিক চেহারা থেকে সাবধান
“আপনি যখন তাদেরকে দেখেন, তখন তাদের দেহাবয়ব আপনার কাছে প্রীতিকর মনে হয়। আর যদি তারা কথা বলে, তবে আপনি তাদের কথা শুনেন। তারা প্রাচীরে ঠেকানো কাঠসদৃশ্য।” [সুরা মুনাফিক্বুন: ৪]

সাহল (রাঃ) থেকে বর্ণিত, “এক ব্যক্তি রসুল (সাঃ) এর নিকট দিয়ে অতিক্রম করছিল। তখন তিনি সাহাবাবর্গকে বলছিলেন, এ লোক সম্পর্কে তোমাদের ধাণা কি? তারা উত্তর দিলেন, এ লোকটি কোথাও কোন মহিলাকে বিয়ের প্রস্তাব দিলে, তার সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয়। যদি সে সুপারিশ করে তবে তার সুপারিশ গ্রহণ করা হয়, যদি সে কথা বলে তবে তা শোনা হয়। অতপর রাসুল (সাঃ) চুপ থাকলেন। এর কিছুক্ষণ পর সেখান দিয়ে একজন গরিব মুসলিম অতিক্রান্ত করতেই রাসুল (সাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, এ ব্যক্তি সম্পর্কে তোমাদের কি ধারণা? তাঁরা বললেন, এ লোকটি কোথাও বিয়ের প্রস্তাব পাঠালে তা গ্রহণ করা হয় না। যদি সে সুপারিশ করে তবে তা গ্রহণ করা হয় না, যদি সে কোন কথা বলে তাহলে তা শোনা হয় না। তখন রসুল (সাঃ) বললেন, দুনিয়া ভর্তি ঐ সব ধনী লোকদের চেয়ে এই দরিদ্র লোকটি উত্তম।” (বুখারী)

৪. বিবাহের পূর্বে সম্ভাব্য জীবনসঙ্গীকে দেখে নেওয়া
“তবে সেসব মেয়েদের মধ্যে থেকে যাদের ভাল লাগে তাদের বিয়ে করে নাও।” [সূরা নিসাঃ০৩]

মুগীরা ইবনু শুবা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, “তিনি এক মহিলার নিকট বিয়ের প্রস্তাব প্রেরণ করেন।রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, তাকে দেখে নাও। এটা তোমাদের মধ্যে ভালবাসার সৃষ্টি করবে।” (তিরমিযি, ইবনে মাযাহ)

মানবজীবনকে সুখময় ও স্থায়ী করার মানসে ইসলামে বিয়ের পূর্বে কনেকে দেখে নেওয়ার স্পষ্ট ঘোষণা দেয়া হয়েছে। জাবির (রাঃ) একটি গাছের ডালে বসে গোপনে প্রস্তাবিত কনেকে দেখে নিয়ে ছিলেন। (মুসনাদে আহমাদ)

বিয়ের পূর্বে দেখে নিলে ভবিষ্যৎ স্ত্রী সম্পর্কে মনের খুঁতখুঁতে ভাব ও সন্দেহ দূর হয়ে যাবে। শুধু তাই নয়, এর ফলে ভবিষ্যৎ স্ত্রীর প্রতি আকর্ষণ জাগবে।

“যখন তোমাদের কেউ কোন মেয়েকে বিবাহের প্রস্তাব দিবে, তখন তার জন্য উচিত হল কনেকে দেখে নেওয়া। যদি তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ার উদ্দেশ্যে দেখে, যদিও তা সে মেয়ে না জানে”। (ত্বহাবী,মুসনাদে আহমাদ,তাবরানী)

বিভিন্ন হাদিসে গভীরভাবে দৃষ্টি দিলে একটি বিষয় স্পষ্ট হয় যে, বিয়ের পূর্বে মেয়ের শুধুমাত্র হাত বা চেহারা ছাড়াও তার পায়ের নলার অংশ, গোস্ত, কাঁধ, চুল বা অনুরুপ কিছু দেখা যাবে বলে ইঙ্গিত পাওয়া যায়। শাইখ আলবানী বিভিন্ন ফুকাহ কেরামের মতামত পর্যালোচনা করে উক্ত মতটিকে প্রাধান্য দিয়েছেন। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে, দেখাটা যেন বিয়ের উদ্দেশ্যে হয়। অন্য কোন কুরুচিপূর্ণ মানসিকতা নিয়ে নয়। এমনিভাবে, কনের অভিভাবকও ছেলের দ্বীনদারিত্ব বা তার আচার আচরন দেখতে পারেন।

৫. একজনের প্রস্তাবের উপর অন্যজনের প্রস্তাব না দেওয়া
“নিশ্চয়ই আল্লাহ সীমালঙ্ঘনকারীদেরকে পছন্দ করেন না।” [সুরা বাকারা: ১৯০]

“যারা বিনা অপরাধে মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীদেরকে কষ্ট দেয়, তারা মিথ্যা অপবাদ ও প্রকাশ্য পাপের বোঝা বহন করে।” [সুরা আহযাব: ৫৮]

যে নারীর কোথাও বিয়ের কথাবার্তা চলছে তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়া বৈধ নয়।

আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, “কেউ তার ভাইয়ের প্রস্তাবের ওপর যেন প্রস্তাব না দেয়, যতক্ষণ না সে তাকে বিবাহ করে অথবা প্রস্তাব প্রত্যাহার করে নেয়।” (বুখারী, নাসায়ী)

হ্যাঁ, দ্বিতীয় প্রস্তাবদাতা যদি প্রথম প্রস্তাবদাতার কথা না জানেন তবে তা বৈধ। এ ক্ষেত্রে ওই নারী যদি প্রথমজনকে কথা না দিয়ে থাকেন তবে দু’জনের মধ্যে যে কাউকে গ্রহণ করতে পারবেন। যদি প্রথম জনের প্রস্তাব গৃহীত না হয়, তাহলে দ্বিতীয় জন প্রস্তাব দিতে পারে।

→চলবে→