আপনার ভবিষ্যৎ স্বপ্ন, বাস্তবতা এবং আপনার কাছে সুখের সংজ্ঞাটা যদি আপনার জীবনের উদ্দেশ্যের সাথে সমান্তরাল না হয় তাহলে সব সমাধানই আপনার জন্য ব্যর্থতার কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
একক ভাবে আপনার ইতিবাচক স্বপ্ন, বাস্তবতার প্রতি ইতিবাচক মনোভাব এবং সুখের নিগুড় তত্ব, কিছুই কাজে আসবে না। প্রায় সব ফুলেই মালা গাঁথা যায়, কিন্তু একটি ফুলের মালায় সবগুলো ফুল সমান ভাবে নিখুঁত থাকে না।একটি মালার সৌন্দর্য একক ফুলের কৃতিত্ব নয়, বরং ফুলের সমাহারের। আর ফুলের সমাহারকে স্থায়িত্ব দেয় একটি তুচ্ছ সুতো। যে সুতোটি ফুলের পাপড়ির আড়ালে অদৃশ্য থেকে যায় তাকে ছাড়া কি মালা হয়?সেই সুতোর কথা যিনি মালা গাঁথেন তিনি ছাড়া আর কে খেয়াল রাখে? খুব কম মানুষই খেয়াল রাখে। আপনি যখন আনমনে উদ্দেশ্যহীন হয়ে ঘুরে বেড়ান তখন চোখের সামনে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ফুলটি আপনার দৃষ্টি কাড়বে। আপনি হয়তো ফুলটি তুলে নেবেন। কিন্তু সেই ফুলেরই পাশেই যে আরেকটি ফুল আছে যেটি কোনো না কোনও ভাবে একটু কম নিখুঁত তা কিন্তু আপনি তুলে নেবেন না। সেটি আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করবে না। অথচ ঐ একটা ফুল, যেটি আপনি সংগ্রহ করলেন সেটি আপনাকে আনন্দ দেবে। এটি আপনার উদ্দেশ্যহীন কাজ যাতে আপনার চাহিদার প্রভাবটা বেশি।
ফুলটি তুলতে পেরে আপনি ভাববেন এটাই বুঝি সুখ। কিন্তু এই কাজটি পর পর কয়েকদিন করার পর আপনি নিজেকেই জিজ্ঞেস করবেন যে "কেন আমি প্রতিদিন বাগানের নিখুঁত ফুল টা তুলে নিচ্ছি?"। এবার আপনি হিসেবের খাতা খুলে বসবেন, প্রতিদিন এই ফুল তোলার পেছনে আপনার শ্রম ও মুনাফার হিসেব করে যদি দেখেন কোনও লাভ হচ্ছে না তখন ঐ সুখের কাজটিই আপনি ছেড়ে দেবেন। আর যদি দেখেন আপনার এতে লাভ হচ্ছে তখন আপনি প্রতিদিন ফুল নিতে আসবেন।এইতো! আপনি একটি উদ্দেশ্যের বাঁধনে আটকা পড়ে গেলেন। কিন্তু যিনি উদ্দেশ্যহীন
ভাবে হাঁটতে হাঁটতে এসে ফুল তোলেন না বরং ফুলের মালা তৈরি করাটা যার উদ্দেশ্য তিনি কিন্তু শুধু নিখুঁত ফুলটাই নেবেন না বরং সব গুলো ফুলই তুলে নেবেন। শুধু তাই নয়, চলার পথে মালা গাঁথার উপযুক্ত সুতো পড়ে থাকতে দেখলে সেটাও তুলে নেবেন। শুধু মালা গাঁথাই যদি তার উদ্দেশ্য হয় তাহলে তিনি সেটা নিয়মিত করবেন না। কিন্তু মালা গাঁথার পেছনে যদি তার অন্য কোনও উদ্দেশ্য থাকে তাহলে তিনি সে কাজ উদ্দেশ্য হাসিল হওয়া পর্যন্ত করে যাবেন।
দেখুন,কিভাবে "উদ্দেশ্য" কতগুলো তুচ্ছ থেকে বড় কাজকে একত্রিত করে তাতে একটা সার্থকতা দান করছে। কাজগুলোকে অর্থবহ করে দিচ্ছে। আমাদের জীবনের উদ্দেশ্যটাও কিন্তু সেই সুতোর মতো। অসংখ্য চাহিদা ভিত্তিক স্বপ্ন, বাস্তবতার তাগিদ ও সুখের পেছনে ছুটে চলার নাভিশ্বাসে আমরা আমাদের জীবনের সেই সুতোটির কথা বেমালুম ভুলে যাই। অথচ যিনি আমাদেরকে এতো বৈচিত্র্যময় জীবনের আঙ্গিক দিয়ে তৈরি করেছেন তিনি কিন্তু জীবনের উদ্দেশ্যের কথা ভুলেন নি, শুধু তাই না, আমরাও যেন ভুলে না যাই সে জন্য তিনি বার বার আমাদেরকে তা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। কারণ একটাই, আমাদের জীবনের উত্থান-পতন,তুচ্ছ কাজ-বড় কাজ, দুঃখ-বিষাদ, আনন্দ, স্বাচ্ছন্দ্য সব কিছুই অর্থবহ হয়ে উঠে যদি আমরা আমাদের জীবনকে "জীবনের উদ্দেশ্যের" আলোকে সাজাতে পারি।
এগুলো বলার উদ্দেশ্য হল যারা স্রেফ একাকীত্ব ঘুচানোর জন্য
বিয়ে করতে চাইছেন, একজন আপন ও অন্তরঙ্গ সঙ্গী পেতে বিয়ে করতে চাইছেন কিংবা আপনার অদম্য চাহিদাকে হালাল ভাবে মেটাবার জন্য বিয়ে করতে চাইছেন তাদের তরে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার জন্যই উপরের কথাগুলো টেনে আনা....
বিয়ে করার উদ্দেশ্য কি স্রেফ চরিত্র রক্ষার নামে হালাল উপায়ে যৌন চাহিদার চরিতার্থ করা? এর মানে কি এমন একজন সঙ্গী খুঁজে নেয়া যার সাথে মনের না বলা কথা শেয়ার করা যাবে? রোমান্টিক কিছু সময় কাটানো যাবে? অথবা সুন্দর চামড়ার একটা সুন্দর (রী) সঙ্গী বিয়ে করা যাতে কিউট কিউট দু- চারটা বাচ্চা হবে এবং তাদের সুন্দর কিউট চেহারার দিকে তাকিয়ে ওদের ভবিষ্যৎ গড়ার নেশায় জীবন অতিবাহিত করে দেয়া? এরকম মনোবাঞ্ছা যাদের মনে বিন্দু পরিমাণও আছে তারা অধিকাংশই জীবনে অনেক বেশি ভয়ানক পরিস্থিতির মুখোমুখি হবেন। কারণ আপনি নিজেই নিজের জীবন পথে অনেকগুলো ফাঁদ পেতে রেখেছেন যাতে আটকা পড়ে গেলেই সমূহ বিপদ। যারা স্রেফ একাকীত্ব ঘুচানোর জন্য বিয়ে করতে চাইছেন তারা বিয়ের পরে অচিরেই আবার একাকীত্ব ফিরে পেতে চাইবেন। যারা আপন ও অন্তরঙ্গ সঙ্গী পেতে বিয়ে করতে চাইছেন তারা বিয়ের পরে একে অপরের মধ্যে ছোট- বড় মিল অমিলের জঞ্জালে পড়ে অন্তরঙ্গতা নিয়ে ধান্দায় পড়ে যাবেন। যারা অদম্য চাহিদাকে হালাল ভাবে মেটাবার জন্য বিয়ে করতে চাইছেন তারা প্রয়োজন মেটানোর পরে সাংসারিক আনুষঙ্গিক ঝামেলা দেখে পালাতে চাইবেন। না বলা কথা গুলো শেয়ার করতে করতে ফুরিয়ে যাবার পরে একটা শেষ দেখতে চাইবেন। বয়সের ভারে সৌন্দর্য হারিয়ে গেলে বিকল্প খুঁজতে ইচ্ছে করবে।বাচ্চাগুলো আপনার চাহিদা মতো কিউট না হলে আবার মনমরা হয়ে পড়ে থাকবেন।আবার ছেলে-সন্তান সম্পর্কিত অনাকাঙ্ক্ষিত ঝামেলার পাহাড় দেখে কোথাও পালাতে চাইবেন।
এভাবে একের পর এক অসংখ্য অজানা- অচেনা ঝামেলা এসে যখন আপনাকে ঘিরে ধরবে তখন পালাবার পথ না পেয়ে মাথা ঠুকে মরবেন। কারণ আপনার উদ্দেশ্যটি আল্লাহ সুবাহানাহু ওয়া তা'য়ালার শিখিয়ে দেয়া উদ্দেশের সাথে পুরোপুরি মিলে নি।
অনেকেরই বিয়ে করার অদম্য ইচ্ছাটি প্রকাশিত হয় তাদের কিছু অদম্য শারীরিক, মানসিক ও রোমান্টিক চাহিদা থেকে। এখন সেটাকে "আর্লি ম্যারিজের" নানাবিধ যৌক্তিকতার আশ্রয়ে উপস্থাপন করে একটা পরিশীলিত রূপ দেয়া হয় যাতে তাদের দাবীটাকে ইসলাম ও বাস্তবতার দাবী হিসেবে চালিয়ে নেয়া যায়। নিজের চাহিদাকে চরিতার্থ করতে ইসলামিক যুক্তিগুলোর আশ্রয় নেয়াটা অনেক অনেক ভয়ংকর কাজ। আমাদেরকে বুঝতে হবে কেন আমরা বিয়ে করবো। আমাদের বিয়ের সাথে আমাদের সৃষ্টির সামঞ্জস্যতা কোথায় তা আমাদেরকে জানতে হবে বুঝতে হবে। উপরের উদাহরণে যেমনটি বলেছি, মালা গাঁথা তখনই সার্থক হবে যখন এর পেছনে এমন একটি বড় উদ্দেশ্য থাকবে যা মালা গাঁথার আনুষঙ্গিক কষ্ট ও আনন্দের ব্যাপারগুলোকে একই সুতোতে বাঁধতে পারবে।
একটা মালার সৌন্দর্যে যেমন নিখুঁত ও অ-নিখুঁত দু ধরণের ফুলেরই অর্থবহ অবদান থাকে, এবং সেই অবদানটি বুঝেন বলেই যিনি মালা গাঁথেন তিনি নিখুঁত ফুলটির পাশাপাশি অ-নিখুঁত ফুলগুলোকেও সংগ্রহ করেন তেমনি বিয়ের ক্ষেত্রেও সঠিক উদ্দেশ্যটি বুঝতে পারলে আমরা আমাদের দাম্পত্য জীবনের সমুদয় চাওয়া, পাওয়া, না পাওয়া, দুঃখ, কষ্ট গুলোর অবদানকে বুঝতে পারবো। সেই সাথে বিয়ের উপভোগ্য বিষয়গুলোর সাথে সাথে ত্যাগে ও কষ্টের বিষয়গুলোকেও সানন্দে মেনে নেয়ার মানসিকতা পাবো। আমরা আমাদের জীবনের উদ্দেশ্যের সাথে যদি বিয়ের উদ্দেশ্যের সাথে সামঞ্জস্যতা প্রতিষ্ঠা করতে পারি তাহলে আমরা সহজেই বুঝতে পারবো বিয়ের সার্থকতা।
এমন কিছু বিষয় আছে যেগুলো আপনি চাইলে বা পাইলে তার চেয়ে অপেক্ষাকৃত ছোট জিনিসগুলো এমনিতেই (বোনাসের মত) চলে আসে।তাই বিয়ে যদি হয় আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন এবং আখিরাতের মুক্তি লাভের উদ্দেশ্যে তাহলে জীবনের উদ্দেশ্য ও বিয়ের উদ্দেশ্য একীভূত হল। এখন বিয়ের পরের যাবতীয় ঝামেলা, দায়িত্ব-কর্তব্য, ত্যাগ তিতিক্ষা, দুশ্চিন্তা, অনিশ্চয়তা, কষ্ট ও দুঃখ কে আপনি অনেক অর্থবহ হিসেবে দেখতে পাবেন। আপনার মনে অন্তরঙ্গতার উপভোগ্যতা, রোমান্টিকতা, শারীরিক মিলন ও অন্যান্য উপভোগ্য বিষয়ের পাশাপাশি যাবতীয় ঝামেলা, দায়িত্ব-কর্তব্য, ত্যাগ তিতিক্ষা, দুশ্চিন্তা, অনিশ্চয়তা, কষ্ট ও দুঃখ একই মালার ফুল হিসেবে স্থান পাবে। আপনি বুঝবেন জীবন সুন্দর এজন্যে নয় যে সেখানে শুধুই সুখ আছে, জীবন সুন্দর এজন্য যে সেখানে সুখ ও দুঃখের অর্থবহ বসবাস আছে। তো বিয়ের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য আপনার দুনিয়াবি লক্ষ্যমাত্রা কি?
বিয়ের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের দুনিয়াবি লক্ষ্যমাত্রা হল আপনি এমন একটি সংসার গড়বেন যে সংসার থেকে যুগের শ্রেষ্ঠ দায়ী, শ্রেষ্ঠ মুজাহিদ ও যুগের শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী সন্তান তৈরি করার প্রচেষ্টা জারি থাকবে নিরন্তর।
শুধু তাই নয়, বিয়ে করে আপনি এমন একটি সংসার গড়বেন যা প্রতিবেশীদের জন্য হবে আলোর উৎপত্তিস্থল। আর এই যদি হয় আপনার বিয়ের উদ্দেশ্য তাহলে আরেকবার চেক করে দেখুন আপনার জীবন সঙ্গীর জন্য ঠিক করে রাখা "রিকোয়ারমেন্ট" চেকলিষ্ট। হ্যাঁ, চেক করে দেখেছেন?
আপনি কি চেক লিস্ট টি নতুন করে সাজাবার প্রয়োজন অনুভব
করছেন? আবার চেক করে দেখুন আপনার ভবিষ্যৎ সাংসারিক স্বপ্ন। কেমন লাগছে! স্বপ্নের অনেক দৃশ্য কি পরিবর্তন করার প্রয়োজন অনুভব করছেন?
No comments:
Post a Comment