Tuesday, 28 February 2017

পৃথিবীতে প্রাণের আগমন ও একজন মুসলিম নারীর করণীয়

পৃথিবীতে একটি শিশুর আগমনে নারীর যে ভূমিকা তা তো অতি স্পষ্ট। সন্তান গর্ভে ধারণ, সন্তান প্রসব, দুগ্ধদান ইত্যাদি সবগুলো পর্যায়ে নারী একক ভূমিকা পালন করে। এ সময় একজন নারীকে অত্যন্ত কঠিন অবস্থার মুখোমুখি হতে হয়। সাধারণ গৃহস্থালী কাজকর্মে পর্যন্ত অন্যের সহযোগিতার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। এই নাযুক মুহূর্তে নারীর দায়িত্বও অনেক বেড়ে যায়। গর্ভস্থিত সন্তানের যথাযথ দৈহিক ও মানসিক গঠনের জন্য মাকে অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হয়। মায়ের এসময়ের চিন্তা-ভাবনা, কাজ-কর্ম ও আচরণের গভীর প্রভাব গর্ভের সন্তানের উপর পড়ে। সকল যুগের অভিজ্ঞ চিকিৎসকগণ এ সময় মাকে অতি সংযত জীবন যাপন করার পরামর্শ দিয়েছেন।

ইউরোপে বহু মানুষের আচার-আচরণ, মেজাজ-মর্জির উৎস সন্ধান করতে গিয়ে দেখা গেছে মায়ের এসময়ের আচরণই এখানে নিয়ামকের ভূমিকা পালন করেছে। ফ্রান্সে এক সাদা দম্পতির কালো সন্তান জন্মগ্রহণ করলে চিকিৎসকগণ খুব আশ্চর্য হলেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, সন্তান মাতৃগর্ভে থাকাকালীন মায়ের সম্মুখস্থ টেবিলে একটি কালো হাবশীর মূর্তি ছিল। মূর্তিটি মায়ের মনোযোগ আকর্ষণ করে তার চিন্তাভবনাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। ফলে সন্তান পিতামাতার মতো না হয়ে সেই মূর্তির মতোই হয়েছে। -মুসলমান আওরাত, মাওলানা আবুল কালাম আযাদ ২১

যখন সন্তান প্রসবের সময় আসে তখন নারী মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়। সন্তান প্রসবের পরও দীর্ঘদিন পর্যন্ত শারীরিক ও মানসিক দুর্বলতার মধ্যে তার সময় কাটে। এ সময় তার প্রয়োজন হয় বিশেষ পরিচর্যার। সন্তানকে দুগ্ধদানের সময়টিও মা ও সন্তান উভয়ের জন্যই অতি গুরুত্বপূর্ণ। শিশুর পরিচর্যার বিষয়টি তো আছেই এসময়ে মায়েরও বাড়তি যত্নের প্রয়োজন হয়। মাতৃদুগ্ধের মধ্য দিয়ে শিশু মায়ের অনেক কিছুই এ সময় গ্রহণ করে। এজন্য মাকে পূর্ণ সংযম ও সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়।

মায়ের গর্ভে শিশুর শিক্ষা

প্রত্যেক মায়ের গর্ভে চল্লিশ দিন পর্যন্ত বীর্য আকারে অবস্থান করে। অতঃপর পরের চল্লিশ দিন জমাট রক্তে পরিনত হয়। এমনিভাবে তা আরো চল্লিশ দিনের মধ্যে গোশতের টুকরায় পরিনত হয়। অতপর আল্লাহ একজন ফিরিশতাকে প্রেরন করেন, গর্ভের শিশুর ব্যাপারে চারটি বিষয় অর্থাৎ রিযিক, হায়াত, ভালো ও মন্দের সম্পর্কে লিখতে বলা হয়। অতপর উক্ত মানব ভ্রুনের মধ্যে রুহ প্রবেশ করানো হয়।- (সহীহ বুখারী ও মুসলিম)

মেডিক্যাল সায়েন্স বলে, গর্ভবতী হওয়ার প্রথম মাসেই শিশুর হৃৎপিন্ড তৈরি হয় এবং গর্ভধারনের দেড় মাসের মধ্যে শিশুর হৃৎপিন্ড কাজ করতে শুরু করে। পরবর্তী দুই মাসের ভেতর তার হাত-পা ও অন্যান্য অঙ্গ তৈরি হয়
তিন (৩) মাস পর সে ধীরে ধীরে বড় হতে শুরু করে। পাঁচ (৫) মাস বয়স থেকে সে শুনতে পায়। তাই তৃতীয় মাস থেকে মায়ের করনীয় হল-

আস্তে আস্তে কুরআন হাদীস পড়ার চেয়ে জোরে জোরে পড়া
সুন্দর করে সুর দিয়ে কোরআন তেলওয়াত করা
এসময় রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর জীবনী সশব্দে পড়া
সাহাবায়ে কেরামদের জীবনী সশব্দে পড়া
ইসলামী স্কলারদের লেকচার শোনা
বিভিন্ন দুআসমূহ শব্দ করে পড়া

পঞ্চম মাস থেকে গর্ভের সন্তানের সাথে একা একা কথা বলা যেতে পারে, তাকে ভালো ভালো কথা বলা, রাসুল (সাঃ) এর জীবনী, ইসলামী স্কলারদের লেকচার শোনানো যেতে পারে। এছাড়া এ সময় তাকে কুরআন তেলওয়াতও শোনানো যেতে পারে

একজন মায়ের গর্ভে সন্তান তিল তিল করে বড় হয়। তাই মায়ের চরিত্রের প্রভাব সন্তানের উপরেও পরে। তাই সব ত্রুটিগুলো এখন থেকেই দূর করার চেষ্টা করতে হবে।

সন্তান জন্মের আগে পিতা-মাতার কিছু করনীয়-

উভয়ে উত্তম ও ভাল কাজের নিয়ত করা।
উভয়ে হালাল উপার্জন করা ও হালাল খাদ্য খাওয়া।
দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করা।
সম্ভব হলে মাঝে মাঝে তাহাজ্জুদ সলাত আদায় করা।
দুজনেই বেশি বেশি ভাল কাজ করা।
প্রতিদিন কুরআন তেলওয়াতের চেষ্টা করা।
নিয়মিত কুরআন তেলওয়াত শুনা।
অন্যান্য ইসলামিক বই পড়া।
বেশি বেশি দান-সদকা করা।
অন্যের সাথে ভাল ব্যবহার করা।
গীবত, হিংসা, পরনিন্দা ইত্যাদি দোষগুলো পরিত্যাগ করা।
টেলিভিশন বা ইন্টারনেটে অশ্লীল নাচ বা গান না দেখা।

সর্বোপরি , আল্লাহর কাছে একজন নেক সন্তান লাভের জন্য দুআ করা।
এছাড়া আরো অন্যান্য সওয়াবের কাজগুলো করা।

সন্তানের জীবন গঠনে নারী

একটি সুন্দর শিল্পকর্ম দর্শককে আনন্দ দেয়। সবাই এর কারিগরের প্রশংসা করে। কেননা, এতে তার শিল্পী মনের আন্তরিকতার ছোঁয়া আছে। আছে সৃজনশীলতার স্পর্শ। কারিগর তার মনের মাধুরী মিশিয়ে সামান্য একটি মূল্যহীন মাটির টুকরোকে একটি মূল্যবান শিল্পকর্মে পরিণত করেছে। তার আন্তরিকতা, অধ্যবসায় আর অটুট মনোযোগের কারণে শিল্পকর্মটি সুন্দর ও মনোরম হয়েছে।
একজন সুন্দর ও পরিণত মানুষ নির্মাণের জন্য আরো অনেক বেশি যত্ন, আন্তরিকতা ও অধ্যাবসায়ের প্রয়োজন। পাশাপাশি পিতা-মাতার আচরণ, ঘরের পরিবেশ এসবও সন্তানের ব্যক্তিত্ব ও অভ্যাস গঠনে গভীর প্রভাব ফেলে। শিশু অর শৈশবে যেহেতু পুরোপুরি মায়ের সান্নিধ্যেই থাকে; তাই মায়ের আচার-আচরণ, ভাব-ভঙ্গি, ভাষা-অভ্যাস সব কিছুই শিশুরা অনুকরণ করার চেষ্ট করে। একজন ভালো মা-ই সমাজকে একজন ভালো মানুষ উপহার দিতে পারেন।

এজন্য মায়ের দায়িত্ব অতি গুরুত্বপূর্ণ ও অতি নাযুক। সন্তানকে ভালো ও পরিণত মানুষরূপে গড়ে তোলার জন্য যেমন মায়ের নিজের ব্যক্তিত্বের উৎকর্ষ অপরিহার্য, তেমনি সন্তানের জন্য একটি ভদ্র ও শালীন পরিবেশ নিশ্চিত করাও মায়ের দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত। ঘরের পরিবেশ যদি আল্লাহমুখিতার নূরে নুরান্বিত হয় নামায, তেলাওয়াত, তালীম, যিকির-আযকার, সুন্নতের পাবন্দী ইত্যাদিতে বরকতপূর্ণ হয় তবে তার প্রভাব শিশুর কচি মানসে না পড়ে পারে না। শিশুও তখন আল্লাহ-ভীরুতা আর ইবাদত-বন্দেগীর প্রেরণা নিয়েই বেড়ে উঠবে। ঘরের পরিবেশে যদি সত্যবাদিতা, সহনশীলতা, পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা, মায়া-মমতা, ভদ্রতা ও নম্রতার প্রকাশ থাকে তবে সবার অজান্তেই শিশু ওইসব মহৎ গুণাবলিতে সমৃদ্ধ হতে থাকবে। এজন্যই ইসলামী শরীয়তে পুরুষের প্রতি সন্তানের জন্য দ্বীনদার মা নির্বাচনের তাগিদপূর্ণ আদেশ করা হয়েছে।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিবাহেচ্ছু ‘নারীকে চারটি বৈশিষ্ট্যের কারণে বিবাহ করা হয়- সম্পদের কারণে, আভিজাত্যের কারণে, সৌন্দর্যের কারণে, আর দ্বীনদারীর কারণে, তবে তুমি যেন দ্বীনদার স্ত্রী লাভেই সমর্থ হও।’ -(সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম -মেশকাত ২৬৭)

দ্বীনদার স্ত্রী লাভের প্রতি পুরুষকে উদ্বুদ্ধ করার মূল কারণ দু’টি-

প্রথমত, এতে পুরুষের জন্যও দ্বীনের পথে অগ্রগামী হওয়া সহজ হবে।
দ্বিতীয়ত, দ্বীনদার মা থেকে দ্বীনদার সন্তান জন্মলাভ করবে।

No comments:

Post a Comment