আল্লাহর ফায়সালা ও বান্দার সন্তুষ্টি

আল্লাহর ফায়সালা, সেটি যাই হোক না কেন, তার উপর বিশ্বাস রাখা এবং তাতে সন্তুষ্ট থাকা মুসলিম হিসেবে আমাদের জন্য অত্যাবশ্যকীয়। কিন্তু নির্দিষ্টভাবে যা নির্ধারণ করা হয়েছে, তার উপর সন্তুষ্ট থাকতেও কি আমরা বাধ্য?
আল্লাহর নির্ধারণকৃত ফায়সালা দুই ধরণের হতে পারে;
১। শারঈ বিধান
২। সার্বজনীন ফায়সালা/হুকুম
শারঈ বিধানাবলীর উপর সন্তুষ্ট থাকা আমাদের জন্য আবশ্যকীয়। যেমন-
✒️ আল্লাহ পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের বিধান দিয়েছেন। আমাদের এর আবশ্যকীয়তা বিশ্বাস করতে হবে এবং মেনে নিতে হবে।
✒️ আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন। আমরা এর বৈধতা স্বীকার করতে এবং এতে সন্তুষ্ট থাকতে বাধ্য।
✒️ আল্লাহ রিবা (সুদ) হারাম করেছেন। এটি হারাম হওয়া আমাদেরকে বিশ্বাস করতে হবে এবং মেনে নিতে হবে।
মোটকথা হল শারীয়াহ সংক্রান্ত হুকুমের উপর সন্তুষ্ট থাকা এবং তা মেনে নেওয়া আবশ্যক। কারণ-
“যারা আল্লাহর দেয়া বিধান অনুসারে বিচার-ফায়সালা করে না, তারা কাফির।” [সূরা মায়িদাহ ৫ঃ৪৪]

অন্যদিকে সার্বজনীন ফায়সালা হল এ মহাবিশ্ব ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত হুকুম। যদি এটি কারও জন্য পছন্দনীয় হয় এবং তার স্বভাব-প্রকৃতির অনুকূলে হয় তাহলে তো সেটির প্রতি সন্তুষ্ট থাকা মানুষের সহজাত বৈশিষ্ট্য। যেমন-
✒️ যদি আল্লাহ তাঁর বান্দার জন্য জ্ঞানসম্পন্ন হওয়ার ফায়সালা করেন এবং সে তাতে সন্তুষ্ট হয়
✒️ যদি আল্লাহ তাঁর বান্দার জন্য সম্পদশালী হওয়ার ফায়সালা করেন এবং সে তাতে সন্তুষ্ট হয়
✒️ যদি আল্লাহ তাঁর বান্দার জন্য সন্তানলাভের ফায়সালা করেন এবং সে তাতে সন্তুষ্ট হয়

কিন্তু যদি সেই ফায়সালা মানবপ্রকৃতির অনুকূলে না হয় যেমন অসুস্থতা, দারিদ্র্য, অজ্ঞতা, সন্তান হারানো ইত্যাদি তাহলে এই বিষয়টি নিয়ে আলিমদের মধ্যে মতবিরোধ আছে। কোন কোন আলিম বলেছেন এই ক্ষেত্রেও আল্লাহর ফায়সালার উপর সন্তুষ্ট থাকা আবশ্যকীয়, আবার কেউ বলেছেন এটি মুস্তাহাব (উত্তম)। সঠিক মত হল প্রতিকূল ফায়সালার প্রতি সন্তুষ্ট থাকা মুস্তাহাব। 
তাকদীরের যে বিষয়গুলো মানুষের জন্য প্রতিকূল, সেসব ক্ষেত্রে সে চারটি অবস্থার মধ্যে থাকতে পারে -
১) অসন্তুষ্টি
২)  ধৈর্যশীলতা
৩)  সন্তুষ্টি
৪) কৃতজ্ঞতা

১। অসন্তুষ্টি
কেউ যদি তার সম্পদ নিয়ে দুর্দশাগ্রস্থ হয় আর সে আল্লাহর ইচ্ছার প্রতি অসন্তুষ্ট হয়, সে নিজের চেহারায় আঘাত করতে থাকে এবং কাপড় ছিঁড়ে ফেলে। এক পর্যায়ে আল্লাহর ব্যবস্থাপনাকে সে ঘৃণা করতে শুরু করে। একারণে আল্লাহর রাসূল আহাজারিকারীকে এবং তা শ্রবণকারীকে অভিসম্পাত করেছেন, “সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়, যে গাল চাপড়ায়, কাপড় ছিঁড়ে ফেলে এবং জাহিলিয়্যাতের আহ্বান করে।” 
এই কাজটি, যেটি আসলে একটি কবীরা গুনাহ, এটি কি বিপদের কষ্টকে লাঘব করে? 
না, বরং তাকে বাড়িয়ে দেয়। ঐ ব্যক্তি অতৃপ্ত থাকে এবং বিষাদে জর্জরিত হয়। এমন না যে আপনি যদি কোন একটি কাজ না করতেন,  তাহলে এমন হত না। এই চিন্তাটি শয়তানের একটি ধোঁকা। তাকদীরের ফায়সালা অনুযায়ী নিঃসন্দেহে সবকিছু সংঘটিত হবে।
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “তোমার প্রতি যা হয়েছে তা কখনো না হওয়ার ছিল না, আর যা হয়নি তা কখনো হওয়ার ছিল না।” [আন-নববীর ৪০ হাদিস, ১৯] 
নিঃসন্দেহে আল্লাহ যেমনটি ইচ্ছা করেছেন তেমনটিই হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যদি তোমার প্রতি কোন বিপদ আপতিত হয়, তাহলে বলো না, আমি যদি সেটি না করতাম, তাহলে এমন হত না। বরং বল, আল্লাহ যা ইচ্ছা করেছেন তাই হয়েছে। তোমার ‘যদি’ শয়তানের জন্য দরজা খুলে দেয়।” [সহীহ মুসলিম ৬৪৪১] 
যদি কেউ গাড়ি চালাতে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হয় এবং হতাশ হয়ে বলে, “যদি আমি আজকে গাড়ি নিয়ে বের না হতাম তাহলে আমার গাড়িটি দুর্ঘটনার শিকার হত না।” এটি কি তার কোন উপকারে আসবে? না। কারণ এই দুর্ঘটনা ফায়সালাকৃত ছিল এবং যেকোনভাবেই হোক, সেটি বাস্তবায়িত হত। 

২। সবর (ধৈর্যশীলতা)
কিছু মানুষের উপর বিপদাপদ আসে এবং তারা কষ্ট পায়, কিন্তু ধৈর্য অবলম্বন করে। তারা মুখ দিয়ে এমন কিছু উচ্চারণ করে না যা আল্লাহর নিকট অপছন্দনীয়, আর না অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দিয়ে এমন কোন কাজ করে যাতে আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন। তারা নিজের অন্তরকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং বলে,
“হে আল্লাহ। আমার কষ্টের বিনিময়ে আমাকে প্রতিদান দিন এবং আমাকে এর চেয়ে উত্তম কিছু দিন। নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহর জন্য এবং নিশ্চয়ই তাঁর দিকেই আমাদের প্রত্যাবর্তন।” [সহীহ মুসলিম]

এক্ষেত্রে ধৈর্যের বিধান হল এটি আবশ্যকীয়।
বিপদ ও কষ্টের সময় আবশ্যক হল সবর অবলম্বন করা এবং অননুমোদিত কিছু না বলা বা না করা।

৩। রিদা (সন্তুষ্টি)
সবর (ধৈর্য) ও রিদা (সন্তুষ্টি) এর মধ্যে পার্থক্য হল একজন রাদির (যে সন্তুষ্ট) অন্তর কখনোই ব্যথিত হয় না, এটি সর্বদা আল্লাহর নির্ধারিত ফায়সালার প্রতি সমর্পিত থাকে।  

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যখন কোন মুমিনের জীবনকে সহজ করে দেয়া হয়, তখন সে কৃতজ্ঞ থাকে এবং এটি তার জন্য কল্যানকর। আর যখন তার উপর কোন বিপদ আপতিত হয় তখন সে সবর অবলম্বন করে, এটিও তার জন্য কল্যাণকর।” [সহীহ মুসলিম]

অর্থাৎ, আল্লাহর ফায়সালা মেনে নেয়ার ক্ষেত্রে উভয় অবস্থাই তার জন্য সমান। কঠিন ও সহজ সব অবস্থাতেই সে সন্তুষ্ট।

কোন কোন আলিম বলেছেন এই মানসিকতা রাখা আবশ্যক, তবে অধিকাংশ আলিমদের মতে এটি আবশ্যক না, বরং এটি মুস্তাহাব।
রিদা (সন্তুষ্টি) নিঃসন্দেহে সবরের চেয়ে বেশী পরিপূর্ণ। কিন্তু এটিকে সব মানুষের উপর চাপিয়ে দেয়া এবং দুঃসময় ও সুসময় উভয় ক্ষেত্রে মানুষকে একই অবস্থায় থাকতে বলা আসলে কঠিন এবং তা অনেকেই করতে পারবে না।

৪। শুকর (কৃতজ্ঞতা)
এটি কারো কাছে অদ্ভুত মনে হতে পারে, বিপদগ্রস্থ অবস্থায় একজন কীভাবে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারে? এটি কি মানুষের প্রকৃতির সাথে সাংঘর্ষিক নয়?
মানুষ আসলেই আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করত যদি সে জানত ধৈর্যের সাথে বিপদের মোকাবিলা করার কী প্রতিদান রয়েছে।

আল্লাহ বলেছেন, “সুসংবাদ আস-সাবেরীন (ধৈর্যশীলদের) জন্য। যাদের উপর কোন বিপদ নিপতিত হলে তারা বলে, নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহরই জন্য এবং নিশ্চয়ই আমরা তাঁরই দিকে প্রত্যাবর্তনকারী। এদের উপর তাদের রবের পক্ষ হতে শান্তি ও করুনা বর্ষিত হবে এবং এরাই সুপথগামী।” [সূরা বাকারাহ ১৫৫-১৫৭] 

এই দুনিয়া কতই না তুচ্ছ আর নগণ্য! ধৈর্যের সাথে বিপদের মোকাবিলা করার জন্য কেউ যদি অপরিমিত প্রতিদান লাভ করে এবং আল্লাহর করুণা লাভ করে, তাহলে সে আল্লাহর প্রতি এই নিয়ামতস্বরূপ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে। সে এটিকে আল্লাহর নিয়ামত হিসেবেই দেখবে কারণ এই বিশ্ব ক্ষণস্থায়ী আর পুরস্কার, নিয়ামত, করুণা স্থায়ী।     

বিপদের সময় কৃতজ্ঞ থাকা মুস্তাহাব, আবশ্যক নয়। কারণ এটি সন্তুষ্টির চেয়েও উচ্চ পর্যায়ের।
তবে নিয়ামত লাভের ক্ষেত্রে কৃতজ্ঞ থাকা আবশ্যক।

সুতরাং, এগুলো হল সার্বজনীন ফায়সালার ক্ষেত্রে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে মানুষের অবস্থা। আল্লাহ সর্বাবস্থায় আমাদের সন্তুষ্ট ও কৃতজ্ঞ থাকার তৌফিক দিন। আমিন।

মূল লেখা : শাইখ মুহাম্মদ ইবন সালিহ আল-উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ)
অনুবাদ ও সম্পাদনা : Nashita team